সরকার মুক্ত গণমাধ্যমে বিশ্বাসী

 সিটিজি বুলেটিন ডেস্ক

আপডেট: ২০২৪-০৯-০৪



সরকার মুক্ত গণমাধ্যমে বিশ্বাসী

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মুক্ত গণমাধ্যমে বিশ্বাসী। সরকার চায় গণমাধ্যম ভুলত্রুটি তুলে ধরুক। মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ কথা বলেন। বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি আরও জানান, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রশ্নের জবাবে সম্পাদকরা জানিয়েছেন, এজেন্ডা বাস্তবায়নে যৌক্তিক সময় পর্যন্ত এ সরকার থাকতে পারে, তা হতে পারে দুই থেকে তিন বছর।

এদিকে যমুনার সামনে সম্পাদকদের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে কথা বলেন ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম। তিনি বলেন, আমরা বলেছি, সাংবাদিকদের নামে যত্রতত্র খুনের মামলা হচ্ছে, সেটা যেন বন্ধ করা হয়। এ ব্যাপারে সরকার যেন সুস্পষ্ট ব্যবস্থা নেয়। সাংবাদিকদের যদি কোনো রকম দোষ থাকে, তারা যদি দুর্নীতিতে জড়িত থাকে, তাদের বিরুদ্ধে আলাদা মামলা হবে; কিন্তু এভাবে যেন না হয়।

মতবিনিময়কালে বক্তৃতা করেন প্রথম আলোর মতিউর রহমান, নিউএজের নুরুল কবির, যুগান্তরের সাইফুল আলম, ইনকিলাবের এএমএম বাহাউদ্দিন, দৈনিক ইত্তেফাকের তাসমিমা হোসেন, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের ইনাম আহমেদ, কালবেলার সন্তোষ শর্মা, ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের শামসুল হক জাহিদ, প্রতিদিনের বাংলাদেশের মুস্তাফিজ শফি, বণিক বার্তার দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, দৈনিক আজাদীর এমএ মালেক, পূর্বকোণের ডা. ম রমিজ উদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ। শফিকুল আলম বলেন, মতবিনিময় সভায় দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার ২২ জন সম্পাদককে দাওয়াত দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২০ জন অংশ নেন। দুজন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।

প্রেসসচিব বলেন, ড. ইউনূস সম্পাদকদের বলেছেন, ‘আপনারা লিখবেন, প্রচুর লেখেন, আপনারা জানান। আমাদের দোষত্রুটি থাকলে তা নিয়েও আপনারা লেখেন। আমরা আপনাদের কাছ থেকে শুনতে চাই।’

সবাইকে স্বাধীন ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা করার অনুরোধ করে শফিকুল আলম জানান, সম্পাদকরা বলেছেন, মিডিয়ায় যেসব কালাকানুন আছে, সেই কালাকানুনগুলো যাতে বাদ দেওয়া হয়, সংশোধন করা হয়। ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, স্বাধীন সাংবাদিকতা করতে গিয়ে যাতে কোনো সাংবাদিক কোনো অসুবিধায় না পড়ে, সে বিষয়ে একটা মিডিয়া কমিশন করার প্রস্তাব এসেছে। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের বিবেচনাধীন আছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে শফিকুল আলম বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পাদকদের কাছে জানতে চান, ‘আপনারা বলেন যৌক্তিক সময় কতদিন।’ কয়েকজন সম্পাদক বলেন, ২ থেকে ৩ বছর হতে পারে। একজন সম্পাদক বলেন, সরকারের এজেন্ডা কী? সরকারকে কী কী কাজ করতে হবে? ন্যূনতম কতটুকু কাজ করতে হবে? সেই অনুপাতে সময় নির্ধারণ হবে।’

সরকারের কাজ প্রসঙ্গে সম্পাদকদের বক্তব্যে যেসব পরামর্শ উঠে এসেছে তা তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব। তিনি বলেন, অনেক কথা এসেছে, সংবিধান সংশোধন, সংবিধান নতুন করে লেখা, আইন কমিশন, সংবিধান কমিশন, মিডিয়া কমিশন, পুলিশের জন্য কমিশন, পুলিশকে কীভাবে আরও কার্যকরভাবে কাজে লাগানো যায়, নির্বাচন কমিশন সংস্কারের কথা এসেছে। নির্বাচন কমিশনকে পরিবর্তনসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ এসেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দেশকে কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, এটা একটা মস্ত বড় সুযোগ বাংলাদেশের জন্য, আমাদের সবার জন্য। রাষ্ট্র মেরামত করার জন্য।

আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভ করায় সাজাপ্রাপ্ত ৫৭ বাংলাদেশিকে ক্ষমা করে দিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। এ বিষয়ে প্রেসসচিব শফিকুল আলম বলেন, দেশটিতে এ ধরনের ক্ষমার ঘটনা বিরল। শুধু ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল বিজয়ী, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার পরিচিতি ও সুনামের কারণে এটি করা হয়েছে। ২৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয় নাহিয়ানের। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা প্রবাসী শ্রমিকদের ক্ষমা করে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। বিফ্রিংকালে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার আরেক উপপ্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর।

মাহফুজ আনাম বলেন, ‘আলোচনার মধ্যে এসেছে, আমরা চাই বাংলাদেশে একটি জাতীয় ঐক্য স্থাপিত হোক। আমরা বলেছি, আমরা এই সরকারের কাছ থেকে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আশা করছি। সেই সংস্কারের মধ্যে সংবিধান পরিবর্তন, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশন রিফর্ম করে সত্যিকার অর্থে গণমুখী সংস্থা এবং বিশেষত নির্বাচন কমিশন যেন ভবিষ্যতে সব নির্বাচন সত্যিকার অর্থে জাতির ও ভোটারদের চিন্তার প্রতিফলন ঘটায়-এরকম একটা সংস্থা চাই। আমরা এরকম একটি দুর্নীতি দমন কমিশন চাই, তারা যেন স্বাধীনভাবে কাজ করে।

মাহফুজ আনাম আরও বলেন, আরেকটি কথা বলেছি, বাসস, বিটিভি ও রেডিও-যেটা সরকারের নিয়ন্ত্রণে, এদের স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হোক। পেশাগতভাবে তারা যেন তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে। মিডিয়া নিষ্পেষণের জন্য যত কালাকানুন যেমন: ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট-এ ধরনের সব আইন বাতিল করার কথা বলা হয়েছে। তিনি বলেন, এ মুহূর্তে যেন ঘোষণা করা হয়, এই আইনগুলোয় সাংবাদিকদের নিপীড়নের যে ধারাগুলো আছে, এগুলো কার্যকর হবে না। এটার সংস্কার ওনারা সময় নিয়ে করবেন।

এখানে আরও প্রস্তাব এসেছে সাংবিধানিক সংস্কারের। প্রধান উপদেষ্টা মনে করলে এর জন্য একটি গ্রুপ বা কমিটি করে দিয়ে সব ধরনের আইনের পরিবর্তন করতে পারে। এর মধ্যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, পুলিশ সংস্কার-এগুলোর সবকিছু একটি গ্রুপের কাছে বা বিভিন্নভাবে হতে পারে। অর্থাৎ আমরা এগুলোর গণতান্ত্রিক সংস্কার চাই।

ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, ‘ড. ইউনূস আমাদের বলেছেন, উনি সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন সাংবাদিকতায় বিশ্বাস করেন। আমাদের কাছে ওনার বিশেষ আবেদন হচ্ছে, আমরা যেন লেখনীর মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করি। আমাদের বিভিন্ন পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। আমাদের আহ্বান করেছেন, এ সরকার পরিচালনার সব ক্ষেত্রে ভুলত্রুটি যেন আমরা ধরিয়ে দিই। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মাহফুজ আনাম বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে উপলব্ধি করছি, উনি সত্যিকার অর্থে ভাইব্র্যান্ট মিডিয়া চান। সত্যিকার অর্থে উনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। মিডিয়াবান্ধব সরকারপ্রধান যদি আমরা কখনো পেয়ে থাকি, তাহলে এখন পেয়েছি। এজন্য আমরা অত্যন্ত আনন্দিত।

মাহফুজ আনাম আরও বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতদিন থাকবে, এটা আমাদের কাছে উনি জিজ্ঞাসা করেছেন। এটা নিয়ে অনেকেই মতামত দিয়েছেন বিভিন্ন সময়। কিন্তু মূলকথা যেটা আসছে, সেটা হলো এই সরকারের এজেন্ডা কী? সেই অনুপাতে সময়। অনেক রাজনৈতিক দল বলেছে আপনাদের যতদিন লাগে, কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বলেছে যৌক্তিক সময়। এগুলো তো অস্পষ্ট। ওনার ইচ্ছা, আমরা খবরের কাগজ-টেলিভিশনের মাধ্যমে এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে ওনাকে একটি ধারণা দিই। জাতি কী চায়, কত বছর হতে পারে, দুই-তিন-পাঁচ বছর। এটা নিয়ে ওনার নিজস্ব কোনো চিন্তা নেই। উনি চান জনতার চিন্তা জানতে। সে ব্যাপারে উনি মিডিয়াকে আহ্বান করেছেন। তিনি বলেন, ওনার ধারণা, পৃথিবী এখন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা অনেক উৎসুক এই পরিবর্তনে। তারা চায় বাংলাদেশকে তারা যেভাবে পারে সাহায্য করতে। এটা আমাদের জন্য একটি বড় সৌভাগ্য।